শিরোনাম

বাড়ি ফিরেও হতাশার ছাপ শওকত আলীর চোখে

 প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১২:০৫ অপরাহ্ন   |   সামরিক প্রশাসন

বাড়ি ফিরেও হতাশার ছাপ শওকত আলীর চোখে

ফরিদপুরের বোয়ালমারীর বাসিন্দা শওকত আলী (৪২) সাবেক বিডিআরের একজন সদস্য ছিলেন। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর তাকে যেতে হয়েছে কারাগারে। দীর্ঘ ১৬ বছর পর কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছেন শওকত আলী। জামিনে মুক্ত হয়ে চোখে মুখে অন্ধকার আর হতাশার ছাপ শওকত আলীর। ১৬ বছরের জেল জীবনে হারিয়েছেন মাকে। মায়ের মৃত্যুতেও পাননি প্যারোলে মুক্তি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘ ১৬ বছর কারাভোগের পর নিজ বাড়িতে ফিরতেও পারেননি বিডিআর বিদ্রোহ মামলায় জামিন পাওয়া সাবেক বিজিবি সদস্য শওকত আলী। তার কেবলমাত্র ভিটেটুকু ছাড়া নেই কোনো ঘর-বাড়ি। স্ত্রী-সন্তান থাকেন ভাড়া বাড়িতে। মুক্তির পর এখন চাকরি পুনর্বহালের পাশাপাশি ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছেন শওকত আলী ও তার পরিবারের সদস্যরা।

পরিবার সূত্রে জানা যায়, সাবেক বিডিআর সদস্য শওকত আলীর বাড়ি বোয়ালমারী উপজেলার চতুল ইউনিয়নের বাইখীর-বনচাকী গ্রামে। বাবা আজিজুর রহমান সিকদার মারা গেছেন ২০০৬ সালে। ৬ ভাই ৩ বোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম। ২০০৫ সালে তিনি ঢাকার পিলখানায় ৪৪ রাইফেল ব্যাটেলিয়ন বিডিআরে যোগদান করেন। পরবর্তীতে সরকারের নির্দেশনায় ২০০৯ সালে বিডিআর ব্যাটালিয়নের বিজিবি সদস্য হিসেবে পিলখানায় যোগদান করেন শওকত আলী। এরপর পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ওই বছর ১৬ জুন তাকে গ্রেফতার করা হয়। ওই সময় আড়াই বছর বয়সী এক ছেলে ও স্ত্রীকে রেখে কারাবন্দি হতে হয় তাকে। গত ১৯ জানুয়ারি জামিন পেয়ে আইনি প্রক্রিয়া শেষে ২৩ জানুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। তবে কারাবন্দি থাকা অবস্থায় ছেলের শোকে ২০১৬ সালে মারা যান তার মা হাজেরা বেগম (৬২)।

দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি কারাগারে থাকায় ছেলের লেখাপড়া ও ভরণ-পোষণসহ পরিবারের হাল ধরেন শওকত আলীর স্ত্রী মনিরা পারভিন (৩৬)। একদিকে স্বামীর মামলা পরিচালনার খরচ, অপরদিকে ছেলের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে অমানবিক কষ্ট করতে হয়েছে তাকে। অর্থের অভাবে দিনের পর দিন তিনবেলা ঠিকমতো খাবার যোগাতেও হিমশিম খেতে হয়েছে মনিরা পারভিনকে। তিনি দর্জির কাজ করে কোনোমতে জীবনযাপন করছেন। দীর্ঘ এতো বছর পর জামিনে মুক্তি পেয়ে বাড়িতে ফেরায় আনন্দের চেয়ে হতাশা বেশি শওকত আলীর চোখে-মুখে। দীর্ঘ ১৬ বছর পর স্ত্রী-সন্তানকে কাছে পেয়ে আনন্দের অশ্রুও ঝরছে শওকতের। স্ত্রী ও একমাত্র ছেলেকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে আছেন। পৈত্রিক সূত্রে কেবলমাত্র ভিটেমাটি ছাড়া কিছুই নেই তার।

শওকত আলীর ছেলে নিশাত সিকদার ফাহিম (১৮) বলেন, ছোটবেলায় মায়ের কাছে শুনেছি বাবা দূরে কোথাও আছেন। ছোটবেলায় আমাকে কখনোই ঠিকভাবে বলেনি বাবা কারাবন্দি। বুঝতে শেখার পর জেনেছি বিডিআর বিদ্রোহের মামলায় বাবা কারাগারে আছেন। ছোটবেলা থেকেই বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছি। দীর্ঘ বছর বাবাকে ছাড়া আমাদের পথ চলাটা খুবই কষ্টের ছিল। খেয়ে না খেয়ে মা একা আমাকে মানুষ করেছেন। শওকত আলীর স্ত্রী মনিরা পারভিন বলেন, আমার স্বামী বিনাদোষে জেলে যাওয়ার পর থেকেই আমাদের জীবনযুদ্ধ শুরু হয়। দীর্ঘ ১৬ বছর স্বামী ছাড়া থাকতে হয়েছে, এ কষ্ট শুধু একজন ভুক্তভোগী নারীই বুঝতে পারবে। ছেলের মুখে খাবার তুলে দিতে না পারা মায়ের বেঁচে থাকা আর না থাকা সমান কথা। এখনও অনেক কষ্টের মধ্যে আছি। সরকারের কাছে আমার স্বামীর চাকরি ফেরত এবং ক্ষতিপূরণসহ বেতন ভাতা পরিশোধ করার দাবি জানাই।

শওকত আলী বলেন, আমি কোনো অপরাধ করিনি। বিডিআর বিদ্রোহে আমার কোনো সম্পৃক্ততা পায়নি। অন্যায়ভাবে ১৬টি বছর আমার জীবন থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আমার কোনো বাড়ি-ঘর নেই। বাবার সামান্য একটু ভিটে আছে। কিন্তু সে ভিটেয় যাওয়ার রাস্তা পর্যন্ত নেই। জেলের মধ্যে অসুস্থ অবস্থায় দিন কেটেছে। ২০১৬ ও ২০২২ সালে মেরুদণ্ডের হাড়ে দুইবার অপারেশন করতে হয়েছে। আমার শোকে মা মারা গেছেন, কিন্তু তার মুখটাও দেখতে পারিনি।

তিনি আরও বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি তা অপূরণীয়। এখন মনে হচ্ছে জেলখানাতেই ভালো ছিলাম। অন্তত পরিবারের এমন করুন দশা চোখে দেখতে হতো না। নিজেকে একজন ব্যর্থ স্বামী, ব্যর্থ বাবা মনে হয়। সারাক্ষণ ভাবি এখন আমি কী করবো? কী খাবো? স্ত্রী, ছেলেকে নিয়ে কোথায় থাকবো? সংসার চলবে কীভাবে? এখন মনে হচ্ছে আমি আমার স্ত্রী ও ছেলের ওপর বোঝা হয়ে গেছি। আমার চাকরি ফিরে পাওয়াসহ ক্ষতিপূরণ চাই। এ বিষয়ে চতুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, শওকত আলী একজন সাবেক বিডিআর সদস্য। দীর্ঘদিন তিনি কারাগারে ছিলেন। জামিনে মুক্ত হয়ে এসে তিনি বোয়ালমারীতে একটি ভাড়া বাড়িতে আছেন। তার পৈত্রিক ভিটে ছাড়া ঘর-বাড়ি কিছুই নেই।

সামরিক প্রশাসন এর আরও খবর: