শিরোনাম

১৬ বছর পর মুক্ত বাতাসে বিজিবি'র সুমন

 প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারী ২০২৫, ০৩:০৩ অপরাহ্ন   |   সামরিক প্রশাসন

১৬ বছর পর মুক্ত বাতাসে বিজিবি'র সুমন

পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মুক্তি পাওয়া ১৩৬ জন সাবেক বিডিআর জওয়ানের মধ্যে একজন হাসিনুর রহমান সুমন। দীর্ঘ ১৬ বছর জেল খেটে মুক্তির পর তার পরিবারে বইছে বাধ ভাঙা আনন্দ। স্বজনদের চোখে ঝরছে আনন্দের অশ্রু। সাবেক এ বিডিআর জওয়ান পঞ্চগড় তেঁতুলিয়া উপজেলার শালবাহান ইউনিয়নের সফিউল ইসলামের ছেলে। শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) দুপুরে ঢাকা থেকে বাড়িতে পৌঁছেছেন সুমন। মুক্তির পর থেকেই বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করছিলেন বাবা-মা, ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজনসহ প্রতিবেশীরাও। বাড়িতে ফিরতেই আনন্দের বাধ ভেঙেছে সবার মনে। ১৬ বছর পর কারামুক্তিতে সুমনকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে চোখের পানি ফেলেন স্বজনরা। ৬৫ বছর বয়সী বাবা সফিউল ইসলামও ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কেঁদেছেন আনন্দে। এ সময় সেখানে তৈরি হয় ভিন্নরকম আনন্দের বন্যা।

বিকেলে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, এলাকাবাসী ছুটে আসছেন সুমনের সঙ্গে দেখা করতে। সবাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে চোখের পানি ফেলছেন সুমনও। বলছেন, কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও গণমাধ্যমের ভূমিকার কথা। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার রুদ্ধকর কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দের কথা সুমন শেয়ার করছেন সবার সঙ্গে। 

জানা যায়, ২০০২ সালে সুমন তৎকালীন বিডিআরে যোগ দেন। ৯ বছর চাকরির মাথায় পিলখানার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কারাবন্দি হন। বিদ্রোহী, সিভিল ও বিস্ফোরক আইনে মামলায় জেল খাটেন দীর্ঘ ১৬টি বছর। কারাগারে যাওয়ার ৩/৪ বছর পর ছেড়ে চলে যান স্ত্রীও। নেই সন্তানাদি। জীবন থেকে হারিয়ে যায় ১৬ বছরের ৩২টি ঈদের আনন্দ। অনেক স্বজনের মৃত্যু হলেও ভাগ্য হয়নি দু-মুঠো মাটি দেওয়ার। 

হাসিনুর রহমান সুমন বলেন, ২০০২ সালে আমি বাংলাদেশ রাইফেলস এ যোগদান করি। যোগদানের পর প্রথম পোস্টিং ছিল রাজশাহী। তারপর বান্দরবানের বলিপাড়ায়। সেখান থেকে রাইফেল সপ্তাহ উপলক্ষে আমরা ২০০৯ সালে জানুয়ারি মাসে ৯ তারিখে ঢাকাতে আসি। অনুষ্ঠানে আমরা ৪ হাজারের মতো সৈনিক উপস্থিত ছিলাম। সেই অনুষ্ঠান শেষ করে আমাদের নিজ নিজ স্থানে ফিরে যাওয়ার কথা থাকলেও পিলখানায় ঘটনা ঘটে যায়। সেসব ঘটনা এখন মিডিয়াসহ সব মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। আসলে এর পেছনে কে জড়িত ছিল। হাসিনা সরকার আমলে আমরা ১৬টি বছর কারাবন্দি হয়ে পড়েছিলাম। এই কারাবন্দি জীবনে আমার পরিবার, আত্মীয় স্বজন ও এলাকাবাসী আমার জন্য মন থেকে দোয়া করেছেন। তাদের সবার দোয়া কবুল হয়েছে। বিধায় তাদের মাঝে আজ ফিরে এসেছি।

সুমন আরও বলেন, ঘটনার পর আমাদেরকে কোনো প্রকার জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই তাদের ইচ্ছামতো আমাদেরকে জেলে নিয়ে গেছে। চার্জশিট দিত, ইচ্ছেমতো নিজস্ব বাহিনীর মতো আইন বানালো, সাক্ষ্য ও সাজা দিলো। কোনো প্রকার নথি আমাদেরকে দেখানো হয়নি। আমি আজও জানতে পারিনি সাত বছর আমাকে কোন অভিযোগে সাজা দিয়েছে। এই সাজা শেষ হলো। এরপর আবার সিভিল আইনে দুটি মামলা দিলো। একটি হত্যা আরেকটি বিস্ফোরণ। হত্যা মামলায় তারা ইচ্ছেমতো সাক্ষী বানাতো। তাদের কথা হলো হয় সাক্ষী দাও, নইলে জেলে যাও। ২০১৩ সালে সেই মামলায় আমি খালাস পাই। এরপর শুধু একটি বিস্ফোরক মামলা দিয়ে ২০১৩ সাল থেকে ২০২৫ সালের মুক্তির আগ পর্যন্ত আমাকে আটকে রাখলো।

সুমন বলেন, এরপর যখন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হলো, তখন আমরা আলোর মুখ দেখলাম। এ আলোর মুখ দেখতে সহযোগিতা করেছে ছাত্র-জনতাসহ আজকের এই মিডিয়া (সংবাদমাধ্যম)। তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমাদের পাশে থেকে সংবাদমাধ্যমে রিপোর্ট করেছেন। সুমনের বলেন, আমার নির্যাতিত এই ১৬ বছরের কোনো কিছু দিয়েই ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব নয়। আপনাদের সবার কাছে প্রশ্ন, আমাকে যে বিনা বিচারে, অন্যায়ভাবে আমার মতো এখনো অনেক নিরীহ অনেক লোক জেলখানায় রয়েছে, তারা এখনো মুক্তির স্বাদ নিতে পারেনি। আমি নিজেকে এখনো মুক্ত মনে করতে পারছি না। কেন, যারা আমরা দীর্ঘ ১৬ বছর একসঙ্গে থাকলাম। আমি আমার পরিবারের সঙ্গেও দীর্ঘ ১৬ বছর কাটাইনি। বলবো না সবাই নির্দোষ, তবে বেশির ভাগই নির্দোষ। তারা যতক্ষণ পর্যন্ত বের হতে না পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে স্বাধীন মনে করতে পারছি না।

সুমনের চাচাতো বোন ক্লাশ টেনের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌসী বলেন, আমার তো তখন জন্ম হয়নি। কিন্তু ভাইয়ের কথা শুনেছি। আজ যখন দেখছি খুব আনন্দ লাগছে। সুমনের ছোট ভাই হুমায়ুন কবির সুজন বলেন, সত্যিই আনন্দে আবেগাপ্লুত। দীর্ঘ ১৬ বছর কারাবন্দি থেকে মুক্তি পেয়ে বাড়িতে ফিরে এসেছেন ভাই। এর চেয়ে আনন্দ আর কি হতে পারে। তার জামিনের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপিসহ বিভিন্নভাবে ছোটাছুটি করেছি।

ছাত্রদলের তেঁতুলিয়া উপজেলার আহ্বায়ক নুরুজ্জামান দুলাল বলেন, আপনারা জানেন, পিলখানায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাজানো কিছু মামলা দিয়ে আমাদের অনেক নিরপরাধ বিডিআর ভাইদের ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘ ১৬ বছর কারাবন্দি করে রেখেছিল। এই ১৬ বছর তারা পরিবার-পরিজন হারিয়েছে। তাদের জীবনের ১৬ বছর কেটে গেছে। শুধু পিলখানা হত্যাকাণ্ড কিংবা বিডিআর বিদ্রোহ এই ঘটনাগুলো নয়, আজকে ১৬ বছর পর মুক্ত বাতাসে নতুন জীবনে ফিরে এসেছেন আমাদের বিডিআর সুমন ভাই। তার জীবন থেকে ১৬ বছর কেটে গেছে। আজকে তার মুক্তিতে আমাদের খুব ভালো লাগছে। তার ফিরে আসার খবরে পুরো গ্রামবাসী ছুটে এসেছেন।

শালবাহান ইউপি সদস্য আমিনুর রহমান বলেন, হাসিনুর রহমান সুমন সম্পর্কে আমার ভাগিনা। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর আমাদের সুমন মুক্তি পেয়েছে। এতে আমরা আনন্দিত। সুমনের বাবা সফিউল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ ১৬ বছর পর ছেলেকে পেয়ে কী যে আনন্দ লাগছে তা বুঝানোর মতো নয়। এ ১৬টি বছরের ৩২টি ঈদ গেছে। আমার পরিবারের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে অনেকে মারা গেছে। কোনোটাতেই সে আসতে পারে নাই। তাকে পেয়ে আমি খুবই আনন্দিত। দীর্ঘ সময় ধরে তার পথ চেয়ে বসে আছিলাম।


সামরিক প্রশাসন এর আরও খবর: