ববিতে উপাচার্যের বিরুদ্ধে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিন নিয়ম বহির্ভূতভাবে আরও একটি পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এর আগেও দুটি পদে একই উপায়ে দুজনকে নিয়োগ দেন তিনি। এবার উপাচার্য পিএ টু রেজিস্ট্রার পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নবনিযুক্ত কর্মকর্তা উপাচার্যের কার্যালয়ে কম্পিউটার অপারেটর পদে দায়িত্ব পালন করবেন। জানা গেছে, ২০২৪ মালের মার্চে পিএ টু ভিসি (উপাচার্য) ও পিএ টু রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিজ্ঞপ্তির অনুকূলে কয়েক শত আবেদন জমা হয়েছে। সেই আবেদনের মধ্য দিয়ে যোগ্য কাউকে নিয়োগ না দিয়ে উপাচার্য সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত পছন্দে বুধবার (১২ মার্চ) বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের দপ্তরে পিএ টু রেজিস্ট্রার পদে শিউলি আক্তার নামে একজনকে নিয়োগ দেন। ঠিক তার পনেরো দিন আগে ২৬ ফেব্রুয়ারি শাকিব হোসেন নামে আরেকজনকে পিএটু ভিসি পদে নিয়োগ দেন। এরা দুজনেই রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। উপাচার্যের আদেশক্রমে এই নিয়োগে স্বাক্ষর করেন রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলাম। মনিরুল ইসলামকেও বিতর্কিতভাবে স্বপদে বহাল রেখেছেন উপাচার্য।
১ ফেব্রুয়ারি অবসর গ্রহণের কথা মনিরুল ইসলামের। ৩০ জানুয়ারির এক আদেশে তাকে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাজ চালিয়ে যেতে বলেন উপাচার্য। নিয়ম অনুসারে ওই কর্মকর্তাকে নির্দিষ্ট তারিখে অবসর গ্রহণ করতে হবে। তারপর তাকে পুনর্বহাল করা যেতে পারে। কিন্তু অবসর গ্রহণের আগেই পুনর্বহাল চাকরি নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক সিন্ডেকেটের সিদ্ধান্ত ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদে কাউকে সংযুক্ত রাখারও বিধান নেই। এমনকি কোন প্রক্রিয়ায় তাকে বহাল রাখা হয়েছে তারও উল্লেখ নেই।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মচারী নিয়োগ নীতিমালা ২০২২ দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চুক্তিভিক্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অপাতত বলবৎ অন্য কোনো নীতিমালা যাই থাকুক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন/সংবিধি সমুন্নত থাকার শর্তে এই নীতিমালা প্রাধান্য পাবে। যে কোনো পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে হলে ওই পদে লোক চেয়ে দুবার বিজ্ঞাপন দিতে হবে। তখন না পেলে তা সিন্ডিকেটে তুলতে হবে। সিন্ডিকেট সেখানে সিদ্ধান্ত দেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হবে কি না। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত মোতাবেক সর্বোচ্চ দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। সিন্ডিকেট বা রিজেন্ট বোর্ড যদি মনে করে তাহলে নিয়োগের মেয়াদ এক বছর বাড়াতে পারেন।
ইউজিসির নীতিমালায় সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও এর কোনো নির্দেশনাই মানেননি উপাচার্য। পিএ টু ভিসি ও পিএ টু রেজিস্ট্রার পদে গত বছরের প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির অনুকূলে আবেদন করা কোনো প্রার্থীকে নিয়োগের বিষয়ে আমলে নেওয়া হয়নি। এমনকি রেজিস্ট্রারকে পুনর্বহাল, পিএ টু ভিসি এবং পিএ টু রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগের বিষয়ে সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত নেননি। বরং নিয়োগপত্রে উল্লেখ করে দিয়েছেন, নিযুক্ত ব্যক্তির বিষয়ে সিন্ডিকেট সভায় অবহিত করবেন। যদিও ইউজিসির নিয়ম অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগকর্তা সিন্ডিকেট।
এর আগে আওয়ামী লীগের অনুসারী জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান এবং রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখেন উপাচার্য ড. শুচিতা শরমিন। এ নিয়ে আন্দোলনের মুখে কলিমুল্লাহকে কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়। এবার পিএ টু রেজিস্ট্রার শিউলি আক্তার রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের এবং পিএ টু ভিসি পদে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সাকিব হোসেনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
নিয়ম ভেঙে একের পর এক নিয়োগের পক্ষে মতামত দিয়েছেন দায়িত্ব পুনর্বহাল হওয়া রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলাম। তিনি জানান, পিএ টু রেজিস্ট্রার ও পিএ টু ভিসি পদে নিযুক্তরা সকলেই উপাচার্যের কার্যালয়ে কাজ করবেন। পিএটু রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ হলেও তিনি রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের। এর কারণ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালিয়ে নিয়ে যাওয়া। তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো নিয়মের ব্যত্যয় হয়নি।
রেজিস্ট্রার বলেন, ইউজিসি নীতিমালা ২০২২ গঠিত হলেও তা কার্যকর হয়নি। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয় নীতিমালা অনুসারে স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়। তবে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো নীতিমালা না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৮তম সভায় সিদ্ধান্ত হয় বিশ্ববিদ্যালয় নীতিমালা না হওয়া পর্যন্ত সরকারি চাকরি নীতিমালা অনুসারে চলবে। সে অনুসারে আপতত কাজ চালিয়ে যেতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ উপাচার্য দিতে পারেন।
দুটি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির অনুকূলে আবেদনকারীদের উপেক্ষা করে নিজের পছন্দ অনুসারে নিয়োগ দেওয়া নিয়মের ব্যত্যয় কিনা প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, যারা আবেদন করেছেন তাদের সঙ্গে এই নিয়োগ সাংঘর্ষিক হওয়ার সুযোগ নেই।
রেজিস্ট্রারকে পুনর্বহাল, পিএ টু ভিসি এবং পিএ টু রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগের বিষয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা শুধু লঙ্ঘন নয়, পাশাপাশি উপাচার্য ড. শুচিতা শরমিন ‘স্বৈরতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করছেন বলে মন্তব্য করেছেন ট্রেজারার প্রফেসর ড. মামুন অর রশিদ। তিনি বলেন, সিন্ডিকেট সভা ছাড়া তিনি নিয়োগ দিতে পারেন না। তিনি যা করছেন তা সম্পূর্ণ স্বৈরতন্ত্র। কারো সাথে কোনো পরামর্শ না করে নিজের যা মনে হচ্ছে তাই করছেন। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম রাব্বানী বলেন, উপাচার্য মহোদয় নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করছেন না। ইউজিসির নীতিমালা লঙ্ঘন করে নিয়োগ দিচ্ছেন। অথচ এই পদে নিয়োগের জন্য বিধি মোতাবেক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ এবং তার অনুকূলে আবেদনও করেছে প্রার্থীরা। সেসব উপেক্ষা করে নিজের পছন্দ মতো কাজ করছেন।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে কোনোভাবেই নিয়মের ও প্রক্রিয়ার ব্যত্যয় ঘটেনি বলে জানিয়েছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিন। তিনি বলেন, জরুরি পরিস্থিতিতে কাজ করতে হলে সিন্ডিকেটে পরেও অবহিত করা যায়— সেরকম নিয়ম রয়েছে। জুলাই আন্দোলনের আগ পর্যন্ত যে বাংলাদেশ ছিল এখন বাংলাদেশটা সেই বাংলাদেশ নেই। এখন আমি যে মেয়েটিকে নিয়োগ দিয়েছি (পিএটু রেজিস্ট্রার) সে মেয়েটি শহীদ আবু সাঈদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। অনার্স ও মাস্টার্সে দুটোতেই সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। এ রকম একজন ক্যান্ডিডেট যখন পাওয়া গেছে তখন নিশ্চয়ই গুরুত্ব দেওয়া যায়।
উপাচার্য বলেন, ইউজিসির-২০২২ এর নীতিমালায় বলা আছে দুইবার পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হবে— ওটা ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে প্রকাশ করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তির অনুকূলে জুলাই আন্দোলনের পর এখন যারা আবেদন করেছে তাদের মধ্য থেকেই আমি নিয়েছি।
তিনি বলেন, আপনি নিজেও বোঝেন শহীদ আবু সাঈদের জায়গা থেকে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী দিবসের যে অনুষ্ঠান হয়েছিল সেখানে আমি শহীদ আবু সাঈদের বোনকে নিমন্ত্রণ করেছিলাম।