শিরোনাম

দক্ষিণ এশিয়ায় উন্নয়নে রেমিট্যান্স ও বৈষম্যের প্রভাব, যেখানে এগিয়ে বাংলাদেশ

 প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৫:০০ অপরাহ্ন   |   অর্থ ও বাণিজ্য

দক্ষিণ এশিয়ায় উন্নয়নে রেমিট্যান্স ও বৈষম্যের প্রভাব, যেখানে এগিয়ে বাংলাদেশ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশটির আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা ইউএসএআইডির কার্যক্রম বন্ধ করার পরিকল্পনা করছেন। এরই মধ্যে কয়েক হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করেছেন। বৈদেশিক সহায়তার বন্ধেরও ঘোষণা দিয়েছেন। বৈদেশিক সহায়তা উন্নয়ন, বৈশ্বিক বৈষম্য, নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং চীনের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ ইত্যাদি বিষয়ে বিতর্কের কেন্দ্রে এখন ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ। এতদিন এসব উন্নয়ন সহায়তা সুবিধাভোগী দেশগুলোর কতটা উপকারে এসেছে, বিশেষত দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর উন্নয়নে এই সহায়তার অবদান কেমন, তা খতিয়ে দেখেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স।

গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির মতে, উন্নয়নের উৎস অনেক। সরকারি উন্নয়ন সহায়তা (ওডিএ) এতে একটি ভূমিকা রাখলেও কার্যকর শাসনব্যবস্থা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) অবশ্যই অপরিহার্য, তবে বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থের (রেমিট্যান্স) পরিমাণ এখন ওডিএ ও এফডিএ—এর সম্মিলিত পরিমাণের চেয়েও বেশি!

রেমিট্যান্স প্রবাহের ক্ষেত্রে ভারত শীর্ষে। ২০২৪ সালে দেশটি ১২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে। যেখানে পাকিস্তান ৩৬ বিলিয়ন ডলার ও বাংলাদেশ ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নিয়ে যথাক্রমে পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে। তবে জিডিপির অনুপাতে হিসাব করলে, রেমিট্যান্স প্রবাহে নেপাল বিশ্বে ষষ্ঠ। কারণ, দেশটির রেমিট্যান্সের পরিমাণ মোট জিডিপির ২৫ দশমিক ৭ শতাংশ।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো রেমিট্যান্স থেকে যে বিপুল অর্থ পায়, তা তাদের বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনে এবং দাতাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রভাব থেকে কিছুটা সুরক্ষা দেয়। আসলে অর্থনীতিবিদেরা সম্প্রতি দীর্ঘমেয়াদি এক উল্টো সম্পর্ক চিহ্নিত করেছেন, তাঁরা দেখেছেন, বিদেশি সাহায্য ও রেমিট্যান্স একে অপরের বিকল্প হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ, একটির প্রবৃদ্ধি আরেকটির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দেয়।

তবে রেমিট্যান্স সব সমস্যার সমাধান নয়। নেপালের তথ্য–উপাত্ত দেখায়, রেমিট্যান্সের অর্থ সামঞ্জস্যহীনভাবে ছেলেদের শিক্ষার জন্য ব্যয় করা হয়, মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি করে এবং লিঙ্গবৈষম্যের ধারা আরও দৃঢ় করে। প্রবাসীদের অর্থ পাঠানোর ব্যয় নিয়েও সমালোচনা আছে। বিশ্বব্যাংক ও অভিবাসী অধিকার সংরক্ষণকারী সংগঠনগুলো এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ২০২৪ সালে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন ও মানিগ্রামের মতো বৈশ্বিক অর্থ স্থানান্তরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে রেমিট্যান্সের মোট অর্থের ৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ কেটে নিয়েছে।

এ পর্যন্ত অর্থনীতিবিদেরা মূলত স্থূল অর্থনৈতিক সূচকের ওপর গুরুত্ব দিলেও, এসব সূচক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় মানব অভিজ্ঞতার পূর্ণাঙ্গ পরিধি তুলে ধরা সম্ভব নয়। ১৯৯০ সাল থেকে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) প্রতি বছর ‘মানব উন্নয়ন’ বিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। এই প্রতিবেদন তাদের নির্ধারিত ‘মানব উন্নয়ন সূচক’ (এইচডিআই) অনুযায়ী পরিমাপ করা হয়।

দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে মানব উন্নয়নের স্তর একরকম নয়। এ ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। বর্তমানে দেশটি ১৯২টি দেশের মধ্যে ৭৮ তম অবস্থানে আছে। যেখানে দেশটির এইচডিআই স্কোর শূন্য দশমিক ৭৮, যা বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে বেশি এবং জাতিসংঘের শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী এটি ‘উচ্চ মানব উন্নয়ন’ স্তরে পড়ে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের অগ্রগতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হলেও বাংলাদেশ এই সূচকে ভারতের চেয়ে বেশ এগিয়ে। বাংলাদেশ, ভারত ও নেপাল—এই তিনটি দেশ জাতিসংঘের শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী ‘মাঝারি মানব উন্নয়ন’ স্তরে। এ অঞ্চলে পাকিস্তান সবচেয়ে পিছিয়ে। দেশটি বর্তমানে বিশ্বে ১৬৪ তম অবস্থানে রয়েছে এবং জাতিসংঘের মতে, ‘নিম্ন মানব উন্নয়ন’ স্তরে পড়েছে। পাকিস্তানের এ দুর্বল অবস্থান আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন দেখা যায়, গত বিশ বছরে দেশটি মার্কিন সরকারের কাছ থেকে সরাসরি ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি সহায়তা পেয়েছে। এটি আরও নিশ্চিত করে যে, বৈদেশিক সহায়তা ও উন্নয়নের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল।

জিডিপির শতাংশ হিসেবে সরকারি উন্নয়ন সহায়তা (ওডিএ) এবং মাথাপিছু সরকারি উন্নয়ন সহায়তা উভয়ই ‘সহায়তা নির্ভরতা’ পরিমাপের সূচক। এই নির্ভরতা সুশাসনকে দুর্বল করতে পারে এবং উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশ ও নেপাল সহায়তা নির্ভরতার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। তবে সহায়তা নির্ভরতাই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় নয়—দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দুর্নীতির পরও উভয় দেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। এ ছাড়া, ভারত খুবই সামান্য সরকারি উন্নয়ন সহায়তা গ্রহণ করে, যা দেশটির শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবস্থানের প্রতিফলন। বাস্তবিক অর্থে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত নিজেই সরকারি উন্নয়ন সহায়তার দাতা হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায়। ২০০০ সাল থেকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশে ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, শ্রীলঙ্কায় ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং নেপালে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা পাঠিয়েছে।

ভারতের অর্থনীতি দ্রুত বড় হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের অনুমান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে দেশটির প্রবৃদ্ধি হবে ৭ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২৭ সালে ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে এবং জাপান ও জার্মানিকে ছাড়িয়ে যাবে। তবে এই সমৃদ্ধি সাধারণ মানুষের মধ্যে সমানভাবে বণ্টিত হচ্ছে না। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, অস্ট্রেলিয়ার গিনি সহগ (শূন্য দশমিক ৩৪৩) ভারতের চেয়ে বেশি (শূন্য দশমিক ৩২৮)। গিনি সহগ হলো অসমতার একটি পরিমাপক, যা ০ থেকে ১—এর মধ্যে পরিমাপ করা হয়। এখানে ০ সম্পূর্ণ সমতা নির্দেশ করে, আর ১ চরম বৈষম্য বোঝায়। তবে এই সূচক বাস্তব অবস্থার পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরে না। ইউরোপীয় গবেষণা কাউন্সিল, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও দাতব্য সংস্থাগুলোর অর্থায়নে পরিচালিত ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাব তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে আরও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছে।

অর্থ ও বাণিজ্য এর আরও খবর: