পাচারের টাকা কবে ফেরত আসবে সেটা এখনই বলা মুশকিল

বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থপাচারের বিষয়টি এত ব্যাপকভাবে আলোচিত ছিল যে সাধারণ মানুষের কাছে এখন এটি আর অজানা নেই। তবে অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়েছে, শুধু আওয়ামী লীগ সরকারের কাছেই জানা ছিল না ব্যাপারটা। কারণ সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট আলোচনার সময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘কারা অর্থ পাচার করে, সেই তালিকা তাঁর কাছে নেই। নামগুলো যদি কেউ জানেন, তাহলে যাতে তালিকাটা তাঁকে দেওয়া হয়। ’ ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর শ্বেতপত্র কমিটির দেওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে ২৪০ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করেছে পলাতক শেখ হাসিনা সরকার। ব্যক্তির পাশাপাশি কয়েকটি ব্যাবসায়িক গ্রুপেরও টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান নিয়োগের পর গতি হারিয়েছে পাচারকারী শনাক্তের কাজ—এমন অভিযোগ ব্যাংক থাত সংশ্লিষ্টদের । বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার জন্য গঠিত টাস্ক ফোর্স গঠনের পর সাড়ে চার মাস পার হয়েছে। কিন্তু এখনো এক টাকাও ফেরত আসেনি। তবে জব্দ করা হয়েছে দেড় সহস্রাদিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, যেখানে পাওয়া গেছে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা মূল্যের অর্থ এবং শেয়ার।
তবে একের পর এক গোয়েদা কর্মকর্তা বদলি এবং প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগের কারণে গতি হারিয়েছে পাচারের অর্থ আদায়প্রক্রিয়া। পাচারের টাকা ফেরানো সময়সাপেক্ষ হলেও তা সম্ভব বলে অর্থনীতিবিদ-ব্যাংকাররা আশা প্রকাশ করেন।
পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা হয় পাঁচটি ধাপে। প্রথম ধাপ, অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করা। দ্বিতীয় ধাপে সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। তৃতীয় ধাপ, সংশ্লিষ্ট তদন্ত সংস্থার মাধ্যমে অভিযোগ তদন্ত ও প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা। চতুর্থ ধাপে আদালতে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু এবং শেষ ধাপে অর্থ আদায়। এখনো বেশির ভাগ তদন্ত দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ধাপের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এরই মধ্যে অর্থপাচার অনুসন্ধানে শেখ হাসিনা পরিবারের সদস্যরাসহ দেশের আরো ১০টি শিল্প গ্রুপের আর্থিক লেনদেন তদন্তের জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে।
গত ডিসেম্বরে বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ দেশে ফেরত আনা এবং ব্যবস্থাপনার জন্য আন্ত সংস্থা টাস্ক ফোর্স পুনর্গঠন করে সরকার। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী যুক্তরাজ্যে, এস আলম গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ সাইফুল আলম সিঙ্গাপুরে, আওয়ামী লীগ নেতা মো. আবদুস সোবহান ওরফে গোলাপ যুক্তরাষ্ট্রে, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বেলজিয়ামে এবং আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম কানাডায় অর্থপাচার করেছেন বলে দুদক তদন্ত করছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের অনেক নেতা ও কিছু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ রয়েছে।
সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদপত্র ফিন্যানশিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর অভিযোগ করেছেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে তাঁর সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিরা একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থার সহযোগিতায় ব্যাংক খাত থেকে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা পাচার করেছেন। রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে এক অনুষ্ঠানে তিনি আরো বলেন, যেভাবে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার হয়েছে, তা বিশ্বের অন্য কোনো দেশে হয়নি। চট্টগ্রামভিত্তিক একটি গ্রুপই ২০ বিলিয়ন ডলার পার করেছে। মূলত টাকাটা পাচার হয়েছে যে ব্যাংকগুলো রাজনৈতিক প্রভাববলয়ে ছিল, তাদের মাধ্যমে। ওই সব ব্যাংকের ঋণ নিয়ে তা মেরে দিয়েছে। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নিয়েই এ ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। টাকা কবে ফেরত আসবে, সেটা পরের কথা। তবে তারা এখন পর্যন্ত যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তা ঠিক পথেই আছে। তবে টাকা কবে ফেরত আসবে, এটা এখনই বলা মুশকিল।