শিরোনাম

বাণিজ্যযুদ্ধের ডামাডোলে ভিয়েতনামকে বদলে দেওয়ার পরিকল্পনা যার হাতে

 প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৫, ০৩:৪৬ অপরাহ্ন   |   আন্তর্জাতিক

বাণিজ্যযুদ্ধের ডামাডোলে ভিয়েতনামকে বদলে দেওয়ার পরিকল্পনা যার হাতে

অর্ধ শতাব্দী আগে সাইগন থেকে মার্কিন সেনাদের শেষ দলটি সরে গেলেও সেই যুদ্ধে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দরিদ্র দেশ ভিয়েতনাম। আজকের দিনে সাইগন—নাম পাল্টে যা এখন হো চি মিন সিটি—৯০ লাখেরও বেশি মানুষের আধুনিক মহানগর, উঁচু উঁচু অট্টালিকা ও ঝলমলে ব্র্যান্ডে ভরপুর। দেখলে মনে হতে পারে, এই তো সময় ভিয়েতনামের বিজয় উদযাপনের—চরম দারিদ্র্য থেকে মুক্তি, যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ১০ রপ্তানিকারকের মধ্যে অবস্থান, অ্যাপল ও স্যামসাংয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেশটির সামনে এখনো বড় ধরনের সংকট। এই সংকট মোকাবিলা করে উন্নত বিশ্বের কাতারে পৌঁছাতে হলে ভিয়েতনামকে ‘দ্বিতীয় অলৌকিক সাফল্য’ অর্জন করতে হবে—বাণিজ্যযুদ্ধের ছায়ায় থেকেও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির নতুন পথ খুঁজে বের করতে হবে। আর এই পথ দেখাতে হবে দেশটির শক্তিমান নতুন এক নেতাকে, তিনি হলেন তো লাম।

তো লাম একজন কঠোর নিরাপত্তানীতির সমর্থক, যিনি রাজনৈতিক সংঘাতের পথ পেরিয়ে গত বছর কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষে উঠে আসেন। তিনি মার্গারেট থ্যাচারের মতো সংস্কারপন্থি না হলেও বুঝতে পারছেন, ভিয়েতনামের পুরোনো অর্থনৈতিক কৌশলের দিন ফুরিয়ে এসেছে। ১৯৮০-এর দশকে ‘দোই মই’ সংস্কারের মাধ্যমে দেশটি বেসরকারি খাত ও বৈদেশিক বাণিজ্যের দরজা খুলে দেয়। সস্তা শ্রম, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আর খোলা অর্থনীতি—এই তিনে ভর করে ভিয়েতনাম চীনের বিকল্প হয়ে ওঠে। প্রায় ২৩ হাজার কোটি ডলারের বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করে দেশটি আজ বৈশ্বিক ইলেকট্রনিকস পণ্য সংযোজনের কেন্দ্র। গত এক দশকে দেশটির বার্ষিক প্রবৃদ্ধির গড় হার ৬ শতাংশ, যা ভারত-চীনকেও ছাড়িয়ে গেছে।

বাণিজ্যযুদ্ধের মহাসংকট

ভিয়েতনামের বর্তমান সমস্যার নাম—বাণিজ্যযুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভিয়েতনামের পঞ্চম বৃহত্তম বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশটির পণ্যে ৪৬ শতাংশ শুল্ক বসানোর হুমকি দিয়েছিলেন। যদিও ভিয়েতনাম কৌশলে কিছু ‘উপহার’ দিয়ে সেই হুমকি প্রশমিত করেছে, যার মধ্যে রয়েছে স্পেসএক্সের সঙ্গে চুক্তি, বোয়িংয়ের প্লেন কেনা, এমনকি ট্রাম্প পরিবারের জন্য বিনিয়োগের সুযোগ। গত ২১ মে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুত্র এরিক ট্রাম্প ভিয়েতনামে একটি রিসোর্ট নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তিনি বলেছেন, এটি ‘সবাইকে চমকে দেবে’।এরপরও, তুলনামূলক কম হারে শুল্ক বসানো হলেও ভিয়েতনামের জন্য সেটি হবে এক দুঃস্বপ্ন। এরই মধ্যে দেশটির উৎপাদন খরচ বেড়েছে—ভারত, ইন্দোনেশিয়া বা থাইল্যান্ডের চেয়ে বেশি মজুরি দিতে হচ্ছে। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র যদি চীনা উপাদান, প্রযুক্তি ও পুঁজিকে বাদ দিতে বলে, তবে তাতে ভিয়েতনামের সূক্ষ্ম ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। দেশটি বরাবরই যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ‘দোদুল্যমান’ অবস্থান নিয়েছে।


তো লামের বড় চ্যালেঞ্জঃ

তো লাম এর আগে ‘আগুনঝরা অভিযান’ নামে দুর্নীতি দমনের জন্য পরিচিতি পান। এখন তাকে ভাঙতে হবে পুরোনো অর্থনৈতিক কাঠামো। ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি কিছু ‘আধুনিকতার দ্বীপ’ ঘিরে সীমাবদ্ধ। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো রপ্তানি লক্ষ্য করে বিশাল কারখানা চালায়, কিন্তু উপকরণ তারা বিদেশ থেকেই আনে। স্থানীয় অর্থনীতিতে ছড়ানো পড়ে না তেমন কোনো লাভ। দেশটির রপ্তানির বড় অংশই বিদেশি মূল্য সংযোজন নির্ভর। আবার গুটিকয় রাজনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠ কনগ্লোমারেট—যেমন ভিনগ্রুপ—ব্যাংক, আবাসনসহ অনেক খাত দখলে রেখেছে। এর একটি শাখা ভিনফাস্ট, টেসলার মতো গাড়ি বানাতে চায়, কিন্তু এখনো লোকসানই গুনছে। অপরদিকে, দুর্বল রাষ্ট্রমালিকানাধীন কোম্পানিগুলো চালায় জ্বালানি, টেলিকমসহ অনেক খাত। সবার মধ্যে উন্নয়ন ছড়িয়ে দিতে হলে ছোট ও নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য ক্ষেত্র সমান করতে হবে। এজন্য জটিল লাইসেন্স প্রথা সহজ করতে হবে, দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যাংক খাত সংস্কার করে ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য ঋণের প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। তবে এখানেই রয়েছে বিপদের জায়গা। রাজনৈতিকভাবে উন্মুক্ত ব্যবস্থা ভিয়েতনামের জনগণের উপকারে আসবে—এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এমন পদক্ষেপে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতাধর স্বার্থান্বেষীরা, যারা সীমিত সম্পদে নিজেরাই ভাগ বসায়। এসব ‘অলিগার্ক’দের বাধ্য করতে হবে—আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নামতে হবে, না হলে রাষ্ট্রীয় সহায়তা বন্ধ। দক্ষিণ কোরিয়ার মতো ‘চ্যাবল’-দের (পারিবারিক মালিকানাধীন বৃহৎ করপোরেট গোষ্ঠী) প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে ঠেলে দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নিতে হবে। এদের পেছনে থাকে পার্টি ও প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ সিন্ডিকেট।আশার কথা হলো- তো লাম এরই মধ্যে এক উচ্চ-ঝুঁকির প্রশাসনিক সংস্কার শুরু করেছেন—এক লাখ সরকারি কর্মচারীকে বরখাস্ত করেছেন, অর্ধেক প্রদেশ একীভূত করছেন, বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় বাতিল করছেন। এটা একদিকে প্রশাসনের আধুনিকায়ন, আবার অন্যদিকে প্রচুর শত্রু তৈরি করার ঝুঁকি। অন্যদিকে, বিপদ এই যে, চীনের শি জিনপিংয়ের মতো তো লাম যদি সংস্কারের নামে একনায়কতন্ত্র কায়েম করেন, তবে সংস্কারপ্রচেষ্টাই দমনমূলক সংস্কৃতির শিকার হতে পারে। যদি তিনি ব্যর্থ হন, তবে ভিয়েতনাম কম-মূল্য সংযোজন উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবেই রয়ে যাবে—সুযোগ হারাবে। কিন্তু যদি সফল হন, তবে দ্বিতীয় দোই মই’র মাধ্যমে ভিয়েতনামের ১০ কোটি মানুষ উন্নত বিশ্বের কাতারে চলে যেতে পারবে। আর এই ভাগ্য নির্ভর করছে একজন অনাকাঙ্ক্ষিত অথচ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারকের ওপর—তো লাম-এর হাতে। 

আন্তর্জাতিক এর আরও খবর: